পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন ও এংজাইটি
২০০১ সালের দিকের ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের প্রাক্তন বাসিন্দা আন্দ্রিয়া ইয়েটস তার পাঁচ সন্তানকে বাথটাবের পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেছিলো। এ ঘটনায় টেক্সাস জুরি বোর্ড প্রথমে তার মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিলেও পরে সেটি প্রত্যাহার করে যাবজ্জীবন দেয়। কিন্তু হত্যাকারীর বিচারের দাবিতে পুরো যুক্তরাষ্ট্র আন্দোলনে ফেটে পড়েছিলো। আশ্চর্য শোনালেও সত্য, সেসময় ওই নারীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তার স্বামী রাস্টি ইয়েটস। তিনি বারবার মিডিয়া ও আদালতকে বলেছিলেন, তার স্ত্রী মানসিকভাবে অসুস্থ। বিচারের শেষ দিন পর্যন্ত স্ত্রীর পক্ষে ছিলেন তিনি।
২০১৮ তে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও এরকম মর্মান্তিক খুনের ঘটনা ঘটে। একটি জেনারেল হাসপাতালের পাঁচতলা ভবনের ছাদ থেকে নবজাতককে ফেলে দিয়ে নিজেও লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে সিমা আক্তার নামের পঁচিশ বছরের এক তরুণী।
আমরা সবসময় জেনে এসেছি, সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো তার মা। মা-সন্তানের বন্ধন হয় নাড়ির বন্ধন। পৃথিবীর আর কোনোকিছুর সাথেই যার তুলনা চলেনা সেই মা তাহলে কিভাবে তার সন্তানকে খুন করতে পারেন! মায়েদের এই ভয়াবহ মানসিক ভারসাম্যহীনতাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা। নিজের শরীরের ভিতরেই দশমাস ধরে তিলতিল করে বেড়ে উঠা সন্তানের প্রতি মায়ের বিরূপ মনোভাব হলো এই উদ্ভট রোগের লক্ষণ।
আমরা মনে করে থাকি, সুস্থভাবে বাচ্চা জন্ম দিতে পারলেই হয়তো একজন নারী বিপদমুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এরপরে শারীরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে আরো অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় কোনো কোনো নারীকে। সন্তান জন্মের কয়েকদিন পর থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ নতুন মা বেবি Blue বা ম্যাটারনিটি Blue নামে এক ধরনের বিষণ্ণতায় ভোগে থাকেন। এসময় ঘনঘন মুড সুইং করে, যেকোনো কিছুতেই বিরক্তবোধ করে, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ কান্না শুরু করে। অন্যান্য ডিপ্রেশনগুলোর তুলনায় এটা কম মারাত্মক এবং স্বল্পস্থায়ী। দু’সপ্তাহ পর থেকে এর তীব্রতা মোটামুটি কমে আসে।
পোস্টপার্টাম এংজাইটি নামে মায়েদের আরেকটা মানসিক সমস্যা হয় যেটা মূলত একটা এংজাইটি ডিজঅর্ডার। যেকোন জরুরি বা বিপজ্জনক পরিস্থিতির প্রতি ব্যক্তি স্বাভাবিক যে প্রতিক্রিয়া করে থাকে সেটাই হলো এংজাইটি বা উদ্বেগ। সাধারণভাবে সব মানুষের মধ্যেই দৈনন্দিন কাজকর্ম নিয়ে কমবেশি উদ্বেগ কাজ করে থাকে কিন্তু যখন এর তীব্রতা বেড়ে যায় তখনই এটা ডিজঅর্ডার বা রোগ হিসেবে দেখা হয়। হঠাৎ করে বাচ্চার জন্য রাত জাগতে গিয়ে মায়েদের পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া বা বাচ্চার দায়িত্ব পালন নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করলে, পরিবারের সবকিছু একা একজনকেই করতে হলে তখন মায়েদের মধ্যে এধরনের এনক্সাইটি দেখা দেয়। ফলে মাথা ঘুরা, বুকে অস্বস্তি, শ্বাসকষ্টের মতো লক্ষণ দেখা যায়।
এছাড়া প্রসবকালীন জটিলতা কোনো কোনো নারীর ক্ষেত্রে এতটাই প্রভাব ফেলে যে হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং সন্তান জন্মের মুহূর্তগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে প্রতিনিয়ত দেখা দেয় বলে মন প্রায় বিষণ্ণ থাকে। ফলে বাস্তব জীবন থেকে সরে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চায়। এধরনের লক্ষণ দেখা যায় পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে। সন্তান প্রসবের পর এক থেকে ছয় শতাংশ প্রসূতি নারী এই রোগে আক্রান্ত হন। জন্মানোর সময় তীব্র শারীরিক কষ্ট পাওয়া, স্বাভাবিক প্রসবের বদলে অপরিকল্পিত সিজার, সন্তান জন্মানোর মুহূর্তে হঠাৎ মায়ের জটিলতা বা শিশু জন্মানোর পর সন্তানকে আইসিওতে রাখা ইত্যাদি সমস্যার কারণে প্রসূতি মা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হন।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এর লক্ষণগুলো যখন ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করে এবং ব্যক্তির মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা চলে আসে তখন সেই অবস্থাকে বলা হয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিস। সাইকোসিস হলো এমন এক পরিস্থিতি যেখানে ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, মনের ভাব ও আচরণে এক ধরনের পরিবর্তন আসে যা তার জীবনকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করে। এ পরিস্থিতিতে ব্যক্তি সাধারণভাবে স্বীকৃত বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যায়। পোস্টপার্টাম সাইকোসিসের লক্ষণগুলো বাচ্চা জন্মের ৪৮-৭২ ঘন্টার মধ্যে দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা এটাকে একটা ‘সাইকিয়াট্রি ইমার্জেন্সি কন্ডিশন’ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন কারণ যদি ইমার্জেন্সিভাবে এর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হয় তাহলে মা তার নিজের অথবা বাচ্চার ক্ষতি করে ফেলতে পারে। তবে আশার কথা হলো এটা একটা বিরল রোগ যেটা প্রতি ১০০০ জনে ১ বা ২ জন মায়ের মধ্যে দেখা যায়।
এই ডিপ্রেশনগুলো কেনো হয় সেটার নির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি তবে কতগুলো সম্মিলিত কারণের ফলাফল হিসেবে এসব ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে বাচ্চা জন্মদান পর্যন্ত নানারকম জটিলতার মাধ্যমে একজন নারীকে যেতে হয়। সন্তান জন্মের পর মায়ের শরীরে বিভিন্ন হরমোনের (যেমন: ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন) খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়। কিন্তু শরীর এই আকস্মিক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকে না। ফলে শরীরের বিভিন্ন আন্তঃক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দেয় যেটা মস্তিষ্কের উপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করে। অল্পবয়সে মা হওয়াকেও অনেকে দায়ী করেন।
এছাড়া বাচ্চা জন্মের পর মাকে রাত জাগা থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে বাচ্চাকে মানিয়ে নেওয়া পর্যন্ত সবকিছু নিয়ে প্রসবের অসুস্থ শরীরে অনেক হিমশিম খেতে হয়। ফলে খুব সহজেই মায়েরা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে যান। এসময় পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে একটু সাপোর্টিভ মানসিকতা না পেলে এবং সময়মতো সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ না নিলে এই বিষণ্ণতা (পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন) বেড়ে ভয়ানক আকার ধারণ করতে পারে।
আমরা শারীরিক অসুস্থতাকে গুরুত্ব দিলেও মানসিক সমস্যাকে মানতে চাইনা। অথচ আমাদের সকল কাজ পরিচালিত হচ্ছে এই মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তাচেতনার দ্বারা। তাই মানসিক সমস্যাগুলোকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সুস্থ সন্তান পেতে চাইলে অবশ্যই আগে মায়ের যত্ন নিতে হবে।
“Mothers are great. They outlast everything. But when they’re bad, they’re the worst thing that can happen.”
– Carrie Fisher
লেখক – আসমা ইসলাম, চতুর্থ বর্ষ , মনোবিজ্ঞান বিভাগ, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।