আতঙ্কের অসুখ
প্যানিক ডিজঅরডার (Panic Disorder) হলো এক ধরণের মানসিক অসুখ যাতে ব্যক্তি প্রচন্ড আতঙ্কের শিকার হন এবং এটা দশ-পনের মিনিটের মতো স্থায়ী হবার পর আবার ধীরে ধীরে চলে যায়। অনেকে এধরণের অ্যাটাকের পর ত্রিশ মিনিটের মতো শারীরিক দূর্বলতার কথাও বলেন। প্যনিক অ্যাটাকের হার হলো শতকরা ৩ থেকে ৪ ভাগ। পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে এই রোগ দুই থেকে তিন গুণ বেশী দেখা যায়। প্যানিক অ্যটাকের লক্ষণ হলো- এখনই মারা যাচ্ছি এমন অনুভূতি (এর সাথে থাকে তীব্র আতঙ্ক), বুক ধরফর করা, অতিরিক্ত হৃদস্পন্দন হওয়া, বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি, ঘাম, শরীর ঠান্ডা বা গরম হয়ে আসা, শরীর কাঁপা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, বমি ভাব বা পেটের অসুবিধা, শরীর অসুস্থ লাগা, মাথা হালকা হয়ে আসা, অজ্ঞান হবার অনুভূতি হওয়া বা অজ্ঞান হওয়া, শরীর অবশ হয়ে আসা, শরীর ঝিন ঝিন করা এবং বিভিন্ন রকম ভয়ের চিন্তা ইত্যাদি।
প্যানিকের রোগী সচরাচর কতগুলো পরিস্থিতি ও কাজকে বিপদজনক মনে করে এড়িয়ে চলেন। যেমন, তারা একা একা বাড়ি থেকে দূরে কোথাও যাওয়া, ভীড়, ট্রাফিক জ্যাম, মার্কেট, লিফ্ট্ ব্যবহার, ট্রেন, বাস, লঞ্চ, প্লেন ইত্যাদি ব্যবহার, বড় সমাবেশ, বড় মসজিদের সামনের সারিতে নামাজ পড়া, ডাক্তার নেই এধরণের দূরবর্তী স্থান ইত্যাদি এড়িয়ে চলেন।
কেন হয়?
এরোগের কারণ বিষয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। মস্তিষ্কে রাসায়নিক উপাদানের ভারসাম্যহীনতার কারণে এই অসুখ হয় বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। আরেক মত অনুযায়ী আমাদের সবারই একটি সংবেদনশীল, জন্মগত, শ্বাসরোধ বিষয়ক বিপদসংকেত ব্যবস্থা রয়েছে। যদি এই প্রক্রিয়া খুব সহজেই এবং প্রায়শঃই চালু হয়ে যায় তবে এটি স্বতঃস্ফুর্ত প্যানিক তৈরি করতে পারে। হঠাৎ যে কোন সময়ে, যে কোন পরিস্থিতিতে এধরণের প্যানিক হতে পারে। যেমন, রাত্রে ঘুমের মধ্যেও এমনটা ঘটতে পারে। অন্য একটি মতে বৈবাহিক বা ব্যক্তিগত জীবনে দ্বন্দ্ব/সমস্যা, নিজের বা ঘনিষ্ঠজনের বড় কোন অসুখ, ঘনিষ্ট কারো মৃত্যু, শিশুর জন্ম, গর্ভপাত, আর্থিক সমস্যা, আর্থিক লোকসান, কর্মস্থলে চাপ, স্বাস্থ্য সমস্যা, ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, নেশার প্রতিক্রিয়ায় প্যানিক শুরু হতে পারে। তবে কোন নির্দিষ্ট কিছু ছাড়াও এটি শুরু হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ভয়ের ফলে অধিক দ্রুত শ্বাস নেয়ার ফলে প্যানিক হতে পারে।
প্যানিক ডিজঅরডার ভাল না হবার কারণ
প্যানিক ডিজঅরডার ( Panic Disorder) রোগীদের চিন্তার ধরণে অনেক পরিবর্তন আসে যা তাদের অসুখের টিকে থাকার কারণ হিসাবে কাজ করে। কতগুলো চিন্তা নিচে তুলে ধরা হলোঃ
- ‘আমি এখনই মারা যাবো’।
- ‘আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি’।
- ‘আমার একটি মারাত্মক ও ব্যতিক্রমী অসুখ হয়েছে’।
- ‘আমার বড় কোন অসুখ হয়েছে। ডাক্তাররা ধরতে পারছেননা’।
- ‘বুকে ব্যথার অর্থ আমার এখনই হার্ট ফেইলিয়র (heart failure) বা ব্রেইন স্ট্রোক হবে’।
- ‘আমার টিউমার, পাইলস, ক্যান্সার হার্ট, কিডনি, ব্রেইনের বা শরীরের অন্য কোন স্থানে গুরুতর অসুখ হয়েছে’।
- ‘ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আমার মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গেছে/ হবে’।
- ‘রাস্তায় জ্ঞান হারালে আমাকে কেউ সাহায্য করবেনা। আমি বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পেতে পেতে নির্মম ভাবে মারা যাবো’।
- ‘আমি আর ভালো হবোনা’।
প্যানিকের রোগীরা সারাক্ষণ নিজের অসুখ নিয়ে চিন্তিত থাকেন। অসুখের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা বা বেড়ে গেল কিনা তা নিশ্চিত করতে তারা সারাক্ষণই শরীরের দিকে কড়া নজরদারি চালিয়ে যান। কেউ কেউ হার্ট বিট, ব্লাড প্রেসার এগুলো নিয়মিত মাপেন। অনেকে এমনকি মিনিটে কতবার শ্বাস নিচ্ছেন তারও পরিমাপ করেন। প্যানিকের রোগীরা শরীরের সামান্য খারাপ অবস্থা দেখলেই তার ভুল ব্যখ্যা করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ফলে লক্ষণ বেড়ে প্যানিক অ্যাটাক হয়।
প্যানিকের রোগীরা অনেক ধরণের জায়গা, কাজ ও পরিস্থিতি এড়িয়ে চলেন যা পরিণামে তাদের অসুখকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। যেমন, তারা একা বাইরে যেতে চাননা, ট্রাফিক জ্যামে থাকতে পারেননা বা বাস ব্যবহার করতে চাননা। এছাড়া এরা শারীরিক পরিশ্রমও এড়িয়ে যান। কখনো যদি বাধ্য হয়ে বাইরে যেতে হয় তখন অনেকে সাথে কাউকে নিয়ে বের হন।
কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, প্যনিক ডিজঅরডারের রোগী ঘন ঘন শ্বাস ফেলেন। এর ফলে কতগুলো লক্ষণ তৈরি হতে পারে, যেমন, মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা করা, কানে ধাতব শব্দের মতো শব্দ শোনা, শারীরিক দূর্বলতা, মূর্ছা যাওয়ার অনুভূতি, তীব্র যন্ত্রণার অনুভূতি, অসাড়তা ইত্যাদি। ফলে রোগী ভয় পেযে যেতে পারেন যা লক্ষণগুলোকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে না চললে এবং ঠিকমতো ঔষধ না খেলেও রোগ টিকে থাকে।
করণীয়
- চিন্তার ধরণ বদলে ফেলুন। অধিক ইতিবাচক বা অধিক নেতিবাচক চিন্তায় কোন লাভ নেই। ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা করুন। অগ্রিম চিন্তা করে কোন লাভ নেই। যদি তবুও চিন্তাগুলো আসতেই থাকে তবে এটিকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতে পারেন। ডাক্তার ও টেস্টের ফলাফলের উপর আস্থা রাখুন। ঘন ঘন ডাক্তার বদলাবেননা। নিয়মিত ঔষধ খান। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ খাবেননা, বন্ধ করবেননা, বা ঔষধের মাত্রার মধ্যেও কোন পরিবর্তন আনবেননা।
- অপ্রয়োজনে কারো কাছেই শান্তনা নিবেননা। দৌড়ে হাসপাতালেও যাবার প্রয়োজন নেই। সহ্য করুন। একটু পরে এমনিতেই লক্ষণ কমে যাবে।
- অসুখের লক্ষণ শুরু হলে ঐ বিষযে চিন্তা না করে অন্য কোন বিষয়ে চিন্তা করবেন। কারো সাথে গল্পগুজব করতে পারেন (তবে অসুখের বিষয়ে কথা বলা চলবেনা)। আশে-পাশে থেকে হেটে আসতে পারেন। টেলিফোনে কারো সাথে কথা বলতে পারেন। আশে-পাশের দৃশ্যের দিকে মন দিতে পারেন।
- ধীরে ধীরে পেট ভরে শ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিন। এভাবে চালিয়ে যান। বেশ কয়েক মিনিট করলে আপনার লক্ষণ কিছুটা কমে আসতে পারে।
- যখন প্যানিক অ্যাটাক হয় তখন কাগজের ঠোঙ্গার মধ্যে শ্বাস ফেলে আবার সেখান থেকেই শ্বাস নিবেন। এভাবে কয়েক মিনিট চালিয়ে গেলে আপনার লক্ষণগুলো কমতে শুরু করতে পারে। ঠোঙাটি এমন ভাবে নাক ও মুখের সাথে আটকে নিবেন যাতে বাইরে থেকে অতিরিক্ত বাতাস ঠোঙার মধ্যে না আসতে পারে। তবে একাজে কখনোই প্লাস্টিক ব্যবহার করবেননা।
- একা বের হবেন। সাথে লোক নিয়ে যাবার দরকার নেই। আপনার ভয়গুলো মোকাবেলা করুন। যে কাজে ভয় পান সেগুলো করুন। একবারে না পারলে প্রথমে অল্প ভয়ের কাজ করে, এরপর ধীরে ধীরে আরো বেশী ভয়ের কাজগুলো করে সবশেষে চরম ভয়ের কাজগুলো অভ্যাস করতে পারেন।
- মনে রাখবেন, প্যানিক অ্যাটাকে প্রচন্ড আতঙ্ক ও কষ্ট হলেও এতে মৃত্যু হয়না। অতীতে আপনার বহুবার এধরণের অ্যাটাক হয়েছে। আবার পনেরো- বিশ মিনিটের মধ্যে কেটেও গেছে। এবারো কেটে যাবে। মনে রাখবেন, ডাক্তার বলেছে যে, আপনার শরীরে কোন অসুবিধা নেই। কাজেই ভয় নেই।
- দেহের শারীরিক প্রক্রিয়াগুলো স্বাভাবিক আছে কিনা তা নিয়ে খুব বেশী চিন্তিত না হবার চেষ্টা করুন। এগুলোর দিকে একেবারেই লক্ষ্য করবেননা। শুধু শুধু বার বার রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন ইত্যাদি মাপার প্রয়োজন নেই।
- বিভিন্ন কারণেই শরীরে ক্লান্তি বা কিছুটা খারাপ লাগতে পারে। যেমন, নিদ্রহীনতা, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে, জোড়ে শব্দ হলে, অতিরিক্ত গরম বা অতিরিক্ত শীত পড়লে, বন্ধ জায়গায় অনেক্ষন থাকলে, পরিশ্রম করলে, যৌন মিলন করলে কিছুটা ক্লান্তি বা খারাপ লাগতে পারে।এই খারাপ লাগাটা ভুলভাবে ব্যখ্যা করবেননা।
- প্যানিকের রোগীরা মৃত্যুর ভয়ে খুব ভীত থাকেন। মৃত্যুকে সহজ ভাবে নিতে চেষ্টা করতে পারেন। কেউ চিরজীবী হয়না।
- ব্যস্ত থাকার জন্য কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। আপনি আর বসে বসে মরে গেলাম টাইপের ভয়ের এবং নেতিবাচক চিন্তাা করার অবসর পাবেননা। এজন্য বলা হয়েছে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। ব্যস্ততা আপনাকে প্যানিক অ্যাটাক হতে বের হয়ে আসতে সাহায্য করবে।
- দূরে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন।
- নিয়মিত হাটতে পারেন।
- রিল্যাক্সেশন নামে একধরণের ব্যয়ামের অভ্যাস করলে আপনার লক্ষণ কমতে সাহায্য হতে পারে।পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ফিট-ফাট থাকুন। রোগী রোগী ভাব করে ঘুরলে মন ছোট হয়ে যায়। উপরের বুদ্ধিগুলো প্রয়োগ করেও যদি আপনার সমস্যা সমাধান না হয় তবে আপনার বিশেষজ্ঞ সাহায্যের প্রয়োজন।
লেখকঃ মোঃ জহির উদ্দিন, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, সহকারী অধ্যাপক, সাইকোথেরাপি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট শেরে বাংলা নগর, ঢাকা।
One Response
বার্ষিক পরীক্ষার সময় থেকেই বেশি বেড়ে যায় কোন ভাবেই কনট্রোল করতে পারি না। যদি কোন কার্যকরি ঔষধ থাকে দয়া করে বলুন। মানুষেমানুষের সামনে যেতে লজ্জা হয়।