এসিস্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দীপন চন্দ্র সরকার, ভুয়া সাইকোলজিস্ট ( Fake Psychologist ) সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। সবার জ্ঞাতার্থে তার ফেসবুক স্ট্যাটাস তুলে ধরা হলো।
বেশ কিছুদিন ধরে একটা ফেসবুক পেজ আমার নজরে আসে, পেজটির নাম, “মনোবিজ্ঞানী- The Psychologist.” পেজটির লাইক এর সংখ্যা প্রায় ৪২ হাজারের উপরে। ভাবলাম হয়তো বড় কোন সাইকোলজিস্ট হবেন, আমার উৎসাহ অনেক বেড়ে গেলো। পেজটাতে তিনি বলে দিয়েছেন এখানে বিশেষজ্ঞ সাইকোলজিস্টরা মানসিক সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন এবং মানসিক সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি ইনবক্সে আসতে বলেন। আমার উৎসাহ বেড়ে গেলো, ভাবলাম বেশ ভালো উদ্যোগ, পেজটা নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করা শুরু করলাম, জানার ইচ্ছা জাগলো এত বড় সাইকোলজিস্ট টা কে?
অনেক খোজা খুজির পর পেলাম সাইকোলজিস্ট এর নাম মাকসুদুল হক। তিনি একাধারে সাইকোলজিস্ট এর পাশাপাশি সংস্কৃতিমনা, তিনি পিপলস রেডিও তে মানসিক সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন, প্রতি বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় Help Me নামক একটি অনুষ্ঠানে তিনি মানসিক সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন তিনি বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলেন, তার প্রতি আমার উৎসাহ আরও বেড়ে গেলো, তাকে নিয়ে আমার জানার ইচ্ছা হলো, তার ফেচবুক প্রফাইলে গেলাম সেখানে সাইকোলজি বা সাইকোলজি রিলেটেড কাউকেউ দেখতে পেলাম না তাও যা দুই একজন ছিলো তারাও তার সম্পর্কে কোন বিস্তারিত তথ্য দিতে পারলেন না। আমি ভাবলাম হয়তো তিনি বড় কোন সাইকোলজিস্ট সিনিয়র কেউ হয়তো চিনবে, আমি সাইকোলজির সিনিয়র জুনিয়র অনেকের কাছেই তার সম্পর্কে জানতে চাইলাম কিন্তু কেউই তাকে চিনতে পারছে না। এখন উৎসাহ থেকে ধীরে ধীরে তার প্রতি সন্দেহ বাড়তে শুরু করলো, আমি খোজ করা শুরু করলাম, তাকে ফেসবুকে মেসেজ দিলাম-
– ভাইয়া আমি দেখলাম আপনি সাইকোলজি নিয়ে কাজ করেন, মানসিক সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন, আমি একটু আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আমি কি আপনার ফোন নাম্বারটা পেতে পারি।
– তিনি বললেন অবশ্যই এবং তার ফোন নাম্বারটি আমাকে দিলেন বললেন তাকে মেসেজ দিয়ে রাখতে তারপরে তিনি ফ্রী হয়ে আমাকে ফোন দিবেন।
তিনি আর আমাকে ফোন দেন নি, তবে জানতে চেয়েছেন আমি কি বিষয়ে জানতে চাই, আমিও বলেছি আমি একটু আপনার পরিচয়টা চাচ্ছি। আপনি কোথা থেকে পড়াশুনা করেছেন? কোথা থেকে সাইকোলজি তে ডিগ্রী নিয়েছেন?
– আমি আপনাকে বিস্তারিত পরে জানাবো। আপনি কি একটু আমাকে বলবেন কে আপনাকে দ্বায়ীত্ব দিয়েছে আমার সপর্কে অনুসন্ধান করার জন্য? যাদের জানার প্রয়োজন তারা আমার সম্পর্কে জানেন। আপনি আমাকে যে প্রশ্ন করেছেন সেটি পার্সোনাল, সব কিছু কেন আমি আপনার কাছে জবাবদিহি করতে যাবো!
তার পরিচয় আমি বের করতে পারলাম না, পরে তার দেওয়া ফোন নাম্বার দিয়ে আমি খুজে পেলাম, তিনি BUBT থেকে CSE এর উপরে পড়াশুনা করেছেন। তিনি সংকৃতিমনা, মানুষকে মটিভেট করতে পছন্দ করেন। তার আরও একটা নাম আছে আরিফ হক, তিনি কোথাও আরিফ হক এবং কোথাও মাকসুদুল হক।
তার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য কয়েক জনের মাধ্যমে আমি তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। একজনের কাছে তিনি পরিচয় দেন, তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইকোলজি তে পড়াশুনা করেছেন, কিন্তু সেটা ভিত্তিহীন। তার প্রফাইলে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই লেখা নেই, এমনকি তার কোথাও ছবি পর্যন্ত নেই।
আমি এবং আমরা তার সম্পর্কে খোজ খবর নেওয়াতে তিনি দাবি করেন, তিনি মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলায় নাকি আমাদের ব্যাবসায় পানি ঢেলে দিয়েছেন তিনি। সাইকোলজিস্ট দের নাকি খদ্দের কমে গেছে। তিনি হয়তো জানেন না, সাইকোলজিস্টরা সরকারী হাসপাতাল গুলোতে ফ্রি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন। এর পাশাপাশি অনেকেই নিজ উদ্যোগে ফ্রী মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন, যাদের আর্থিক সমস্যা রয়েছে তাদেরকে ফ্রী সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
তিনি এখানে, তার নিজের পরিচয় গোপন করে মানুষকে পরামর্শ দিচ্ছেন এটা সম্পূর্ন অনৈতিক। তিনি যতই মানসিক সমস্যা নিয়ে মানুষের সাথে কথা বলুন আর মানুষকে উৎসাহিত করুক না কেন সঠিক পরিচয় না দিয়ে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার জন্য পরিচয় গোপন রেখে এধরনের সেবা দেয়া সম্পূর্ণ নীতি বিরুদ্ধ । এমনকি তিনি তার রেডিও অনুষ্ঠানে এমন সব মানসিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন যেগুলো সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই, এভাবে সাইকোলজি বা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে মানুষের কাছে ভুল তথ্য যাচ্ছে।
প্রত্যেকেরই যেমন সাইকোলজিক্যাল সাপোর্টের প্রয়োজন রয়েছে তেমনি আমাদের পরিচিত বন্ধু বান্ধব বা কাছের কেউ চাইলেই সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট দিতে পারেন, কিন্তু তিনি কখনো সাইকোলজিস্ট নয়। একজন প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট এর অবশ্যই সাইকোলজির উপরে পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং ডিগ্রী থাকতে হবে, এর পাশাপাশি তার সাইকোলজিক্যাল বিভিন্ন বিষয়ের উপরে অবশ্যই পর্যাপ্ত ট্রেইনিং এবং সুপারভিশন এর প্রয়োজন হয়। এর পরেই একজন নিজেকে সাইকোলজিস্ট দাবি করতে পারেন।
অনেকে মনে করেন, একজন গায়ক হওয়ার জন্য যেমন সংগীতের উপরে ডিগ্রী নিতে হয় না, একজন সাংবাদিক হওয়ার জন্য যেমন সাংবাদিকতার উপরে ডিগ্রী নিতে হয় না। তেমনি সাইকোলজিস্ট হতে হলে কোন ডিগ্রী বা ট্রেইনিং এর দরকার হয় না। এটা যে কেউ হতে পারে। হয়তো অনেকেই হুমায়ন আহমেদ পড়ে নিজেকে মিসির আলী ভাবতে শুরু করে এবং সাইকোলজি এর প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং ভাবতে থাকে আমি তো মিসির আলী পড়েছি সাইকোলজির সব কিছু জানি আমিও একজন সাইকোলজিস্ট। অনেকেই হয়তো কারও সাথে কথা বলে মন ভালো করে দিয়েছেন আর ভাবা শুরু করেছেন আমিও একজন সাইকোলজিস্ট। সামান্য কিছু কথা বলে দুই একজন মানুষের মন ভালো করে নিজেকে সাইকোলজিস্ট দাবী করলে দেশের প্রত্যেকেই এক একজন সাইকোলজিস্ট।
একজন প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট এর গুনাবলী –
১। সাইকোলজিস্ট তার পরিচয় সাইকোথেরাপি সেশনের শুরুতেই স্পষ্টভাবে দিয়ে দিবেন, এবং তিনি কোথায় আছেন কি করতেছেন, তিনি ক্লায়েন্টের সাথে কোন মেথডে কাজ করবেন সেগুলো ঠান্ডা মাথায় স্পষ্ট করে বলে নিবেন।
২। সাইকোলজিস্ট সেশনের শুরুতে সেশন স্ট্রাকচার সম্পর্কে ক্লায়েন্টকে স্পষ্ট ধারনা দিয়ে থাকেন। এমনকি তিনি তার সাথে কি কি করতে পারবেন এবং কি কি করতে পারবেন না তাও স্পষ্ট করে দেন।
৩। সাইকোলজিস্ট সব সময় ক্লায়েন্টের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করবেন। তিনি কখনো ক্লায়েন্টের তথ্য বাইরে প্রকাশ করেন না এবং এটা সেশনের শুরুতেই ক্লায়েন্টের সাথে বলে নেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তথ্যের প্রকাশ করা লাগতে পারে তাও স্পষ্ট করে বলে দেন।
৪। সাইকোলজিস্ট এমপ্যাথেটিক হবেন।
৫। সবাইকে গ্রহন করে নেওয়ার দক্ষতা থাকবে।
৬। সবার প্রতি বিচারহীন মনোভাব থাকবে।
৭। সাইকোলজিক্যাল বিস্তর জ্ঞান এবং দক্ষতা থাকবে।
৮। পর্যাপ্ত ট্রেইনিং এবং সুপারভিশন থাকতে হবে।
৯। সাইকোলজিস্ট কাউকে সরাসরি কোন পরামর্শ দিবেন না, বরং সাইকোলজিস্ট ক্লায়েন্টকে সাহায্য করবেন যাতে তিনি তার সমস্যার সমাধান নিজে খুজে বের করতে পারেন।
১০। সাইকোলজিস্ট সব সময় ক্লায়েন্টের দৃষ্টিকোন থেকে ক্লায়েন্টকে বোঝার চেষ্টা করবেন।
১১। সাইকোলজিস্ট হবেন গোল ওরিয়েন্টেড, এবং স্পেসিফিক।
১২। একজন প্রকৃত সাইকোলজিস্ট নিজে যতটুকু জানেন তিনি ততটুকু নিয়েই কাজ করবেন, এর বাইরে কাজ করবেন না, তার যে বিষয়ের উপরে ট্রেইনিং নেননি তিনি সেটা নিয়ে কাজ করবেন না। এর পাশাপাশি ক্লায়েন্টের সুবিধার্থে যারা সেই বিষয়ে জানেন তাদের কাছে রেফার করে দেন। যেমন আমি CBT জানি কিন্তু ক্লায়েন্টের প্রয়োজন Family Therapy এক্ষেত্রে যারা Family Therapy জানেন তাদের কাছে তিনি রেফার করে দিবেন। এমনকি অনেক সময় ক্লায়েন্টের সাইকিয়াট্রিক সহায়তার প্রয়োজন হয় তখন সাইকোলজিস্ট তাকে সাইকিয়াট্রিষ্ট এর কাছে রেফার করে দেন।
১৩। সাইকোলজিস্ট কখনো ক্লায়েন্টের বন্ধু না, এবং সাইকোলজিস্ট কখনো বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করবেন না। সাইকোলজিস্ট সব সময় তার প্রফেশনাল জায়গা থেকে কাজ করার চেষ্টা করবেন।
কাজেই ভুয়া সাইকোলজিস্ট ( Fake Psychologist ) থেকে সাবধান থাকবেন, ভালোভাবে জেনে বুঝে যোগ্য সাইকোলজিস্টদের কাছ থেকে মনোবৈজ্ঞানিক সেবা নিন ও মানসিকভাবে সুস্থ্য থাকুন।
লেখকঃ দ্বীপন চন্দ্র সরকার, এসিস্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং
এম.ফিল গবেষক , ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়