সফলতার জন্য আবেগীয় বুদ্ধিমত্ত্বা (E.Q)
-তানজির আহম্মদ তুষার, সহযোগী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সজীব ছোটবেলা থেকেই ভালো ছাত্র। জীবনের সবগুলো পরীক্ষার ফলাফল অত্যন্ত ভালো। পাঠ্যপুস্তক সব মুখস্ত থাকতো তারপরও সে বই এর ভেতর ডুবে থাকতো। মাস্টার্স পাশ করার পরপরই বেশ উচুদরের চাকরীও সে পায়। কিন্ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বসের সাথে কথা কাটাকাটি করে চাকরীটা ছেড়ে দিতে হয়। এরপর আরও কয়েকটি চাকরী একই ভাবে ছেড়ে দিতে হয়। সজীবের বাবা-মা খুবই হতাশ বললেন, “এত কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করলাম, কিন্ত…” একটা দীর্ঘশ্বাস বয়ে যায়। তাদের মাথায় আসেনা কেন সে চাকরী করতে পারে না বা চাকরী ক্ষেত্রের কলিগরাই বা এরকম কেন? অথচ সজিবেরই বন্ধু-বান্ধব যারা সজীবের মতো অতটা ভালো ফলাফল করতে পারেনি, তারাও চাকুরী বা ব্যবসা করে তরতর করে উপরে উঠে যাচ্ছে।
প্রিয় পাঠক, সজীবের বিষয়টি কি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা? নাকি এরকম ঘটনা আমাদের পরিচিত বা পরিজনদের সাথেও ঘটছে? সজীব চাকরী হারানোর কারণে কিছুটা হতাশ হলেও তার কোন শারীরিক বা মানসিক সমস্যা নেই। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা আর কিছুই নয়- সজীবের আইকিউ (IQ) কনেক ভালো হলেও তার আবেগীয় বুদ্ধিমত্ত্বা (Emotional IQ or EQ) ঘাটতি রয়েছে। যার ফলে সে সবার সাথে মিলেমিশে কাজ করে নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে পারছে না। তার মনের আবেগ (যেমন- রাগ, দুঃখ, অভিমান) গুলো সঠিকভাবে প্রকাশ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে ঘটে যাচ্ছে একের পর এক বিপত্তি। আবেগীয় বুদ্ধুমত্তার ধারণাটিই অতুন তাই অধিকাংশ মানুষ এটা সম্পর্কে সচেতন নয়। অথচ এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে মানুষের জবনে সফলতা অনেকাংশে এটার উপর নির্ভর করে। আইকিউ (IQ) মানুষের সফলতার জন্য যথেষ্ট নয়। আইকিউ (IQ) কোন চাকরী পাবার জন্য জরুরী কিন্ত আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা মানুষের চাকুরী পাওয়া ও সফলতা উভয়ের জন্যই জরুরী। মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, মানুষের সফলতার জন্য তার আইকিউ (IQ) ২০% এবং আবেগীয় বুদ্ধিমত্ত্বা (EQ) ৮০% দায়ী।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (Emotional IQ) হচ্ছে মানুষের এমন একটি দক্ষতা বা ক্ষমতা যার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের ও অন্যদের আবেগকে বুঝতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে পারে। ব্যক্তি নিজেকে হা তার চারপাশের মানুষদেরকে কাজে উদ্বুদ্ধ করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছাতে পারে। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা যাদের বেশি তারা অনেক চাপের মধ্যেও নিজেকে শান্ত রেখে কাজ করতে পারে। তাদের আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কগুলো অনেক সুন্দর হয়। বড়বড় নেতাদের কথা যদি চিন্তা করি তাদের মধ্যে এই ক্ষমতা কিন্ত অনেক বেশি। তাদের ডাকে মানুষ মানবতার কল্যাণে জীবন দিতেও পিছপা হয় না। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা শুধু পেশাগত জীবনেই সফলতা এনে দেয় তা নয়। বরং এটি পারিবারিক, দাম্পত্য, সামাজিক, তথা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতা এনে দিতে পারে। আবেগীয় বুদ্ধিমত্ত্বা (Emotional IQ) কে চারটি গুণাবলীতে ভাগ করা যায়। যেমন –
আত্ম-সচেতনতাঃ
আত্ম-সচেতনতা হচ্ছে নিজের মোটিভেশন, আবেগ ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে স্পস্ট ধারণা থাকা, কি তার পছন্দ বা অপছন্দ, তার দুর্বল ও শক্তির দিক এবং তার নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা।
আত্ম-নিয়ন্ত্রণ/ব্যবস্থাপনাঃ
এটি নিজের আবেগগুলোকে সঠিক ভাবে বুঝতে এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন আবেগময় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সঠিকভাবে খাপখাইয়ে চলার ক্ষমতা। ব্যক্তি সবসময় আশাবাদি থাকে, নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন কাজ শুরু করে ও যেকোনো পরিবেশে খাপখাইয়ে নিতে প্রস্তুত থাকে। প্রচণ্ড রাগও সে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আবার প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের বা অন্যদের মধ্যে আবেগ তৈরি করে নিতে পারে।
সামাজিক দক্ষতা / সচেতনতাঃ
এটি ব্যক্তির অন্যের আবেগকে বুঝে তাতে সমানুভুতি (সহানুভুতি নয়) প্রদর্শন করতে সাহায্য করে। এছাড়া ব্যক্তির নিজের অধিকার অন্যকে আঘাত না করেই প্রতিষ্ঠিত, নিজের আবেগ-অনুভুতি সঠিকভাবে প্রকাশ, নিজের প্রয়োজনে অন্যের কাছে সাহায্যে প্রার্থনা, কেউ সাহায্যে করতে না পারলে তা সহজভাবে মেনে নিতে, ভুল হলে ক্ষমা প্রার্থনা, অন্যকে প্রকৃত প্রশংসা করতে, যে কোন পরিবেশে সচতন থেকে আলোচনা ও সম্পর্ক তৈরিসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজ করতে সাহায্যে করে।
সম্পর্কগুলোর নিয়ন্ত্রণ /ব্যবস্থাপনাঃ
এই ক্ষমতাটি ব্যক্তিকে মানুষের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরী ও ধরে রাখতে সাহায্য করে। ব্যক্তি একরোখা না হয়ে ছাড় দিতে পারে, অন্যদের উৎসাহ দিতে পারে, বিভিন্ন সামাজিক পরিবর্তনে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারে, প্রয়োজনে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার ও নেতৃত্ব দিতে পারে কিন্ত সে টিম ওয়ার্ক ও সহযোগিতামূলক পদ্ধতিতে কাজ করে।
ব্যক্তির এই ক্ষমতা গুলো ব্যবহার করে, তার অনুভূতিগুলোর অর্থ ও প্রভাব কি হতে পারে তা অনুমান করে, কি ভাবে কাজ করলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে তা চিন্তা করে ও সেরকমভাবে কাজ করে। ফলে তার চারপাশের মানুষের সাথে অত্যন্ত ভাল ও ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি হয়, সবাই তাকে পছন্দ করতে থাকে। তার কাজে সহযোগিতা করে ও টীমের কাজে সর্বাত্মক ভাবে অংশগ্রহন করে। ফলে জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রে সফলতা তাকে আলিঙ্গন করে। আবেগীয় বুদ্ধিমত্ত্বা কিন্ত আইকিউ এর মতো নয়। আইকিউ ব্যক্তির জন্মসূত্রে পেয়ে থাকে কিন্ত আবেগীয় বুদ্ধিমত্ত্বা অর্জিত অর্থাৎ এটিকে প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে বৃদ্ধি করা যায়। সবাই নিজের আবেগীয় বুদ্ধিমত্ত্বাকে আরেকটু বাড়িয়ে নিন। ভালো থাকুন। অনেক ভালো।