News:

Follow us

পুলিশের বর্তমান মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এবং উত্তরণ

ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যরা কজে যোগদান করলেও মানসিকভাবে পুরোপুরি কাজে ফিরতে পারছে না। তাই এখনও পূর্ণ মনোবল ফিরে পাচ্ছে না।  বর্তমানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যের মধ্যে চারটি বিষয় তাদের মানসিক সাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে থাকতে পারে-  ১। মানসিক দ্বন্দ্ব , ২। কর্মক্ষেত্রে ক্ষেত্রে বৈষম্যে থেকে সৃষ্ট মনকষ্ট, ৩। সাম্প্রতি তাদের উপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ , ৪। পরিবার পরিজন-আত্মীয় স্বজনের সাথে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্নতা ।

মানসিক দ্বন্দ্ব

বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যদের মাঝে দুটি মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়ে থাকতে পারে। প্রথমত, নিজের মূল্যবোধের সাথে দ্বন্দ্ব, ব্যক্তির নিজের মুল্যবোধের সাথে অন্যর জোর করে চাপিয়ে দেয়া দায়িত্ব যখন সাংঘর্ষিক হয় তখন ব্যক্তি নিজের মধ্যে অন্তরদ্বন্দ্ব শুরু হয়।  এই দ্বন্দ্ব নিরসণ না হওয়া পর্যন্ত মনের মাঝে একটা অসস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়। যা থেকে ব্যক্তি পরিত্রাণ পেতে চায়। পরিত্রাণ না পেলে ঐ অ-স্বস্তিকর অবস্থা ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।  দ্বিতীয়ত, বহু সংখ্যক নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের নির্মম ভাবে দমন করতে যেয়ে –গুলি করে হত্যা, জখম, নির্মম অত্যাচার করার কারণে তাদের অনেকের মনে মর্ম পীড়া তৈরি হয়েছে। কাজেই এই অন্তরদ্বন্দ্ব এবং মর্ম পীড়ার কারণে সৃষ্ট মানসিক দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে মানসিকভাবে তাদের বিপর্যস্ত করে ফেলেছে।

কর্মক্ষেত্রে ক্ষেত্রে বৈষম্যে সৃষ্ট মনকষ্ট

কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ে ধরে বৈষম্য ও বঞ্চণার স্বীকার বিশেষ করে – প্রমোশন, বদলি, অতিরিক্ত কর্ম ঘণ্টা তাদের মধ্যে তীব্র মনকষ্ট তৈরি করেছে যা জমে জমে ক্ষোভ তৈরি করেছে। আর এই ক্ষোভের প্রকাশ তাদের আচরণে নির্মমভাবে প্রকাশ পেয়েছে- নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের উপর হামলার মাধ্যমে।   

সাম্প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ

পুলিশের সাম্প্রতিক নির্মম একপেশে আচরণের কারণে সাধারণ জনগনের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। পুলিশের উপর তীব্র আক্রোশ গণপিটুনি, পুলিশ হত্যা, পুলিশের ভবন জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে। ফলে পুলিশ সদস্যদের মাঝে তীব্র ভীতি, আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এছাড়া যারা নিজে সেই ক্ষোভের স্বীকার হয়ছে বা আক্রান্ত হয়েছে ও নিজের চোখের সামনে সহকর্মীর মৃত্যু দেখেছে তাদের মাঝে ট্রমা তৈরি হয়েছে।  অপরদিকে, সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে বর্তমানে কাজে যোগ দেয়া পুলিশ সদস্যরা তীব্র মানসিক চাপের মধ্যে পড়েছে।  

পরিবার পরিজন থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন

তাদের নির্মম কাজের সমালোচনা ও ভৎসনা নিজ পরিবার ও সন্তানদের কাছ থেকে আসায় তারা মানসিক সান্তনার জায়গা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এবঞ্চনা শুধু পরিবার সদস্যদের মধ্যেই সমাবদ্ধ নয় – নিকট আত্মীয় স্বজন এমনকি বন্ধু-বান্ধবদের সান্তনার জায়গা থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে এই মানসিক প্রশান্তির জায়গা হারিয়ে তারা অসহায় হয়ে পড়েছে।

কাজেই এই মানসিক দ্বন্দ্ব, কাজের বৈষম্য, বঞ্চনা ও ক্ষোভ, সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ, এবং পরিবার পরিজনের কাজ থেকে মানসিক সহায়তা হারানো বাংলাদেশের বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যদের অনেকর মাঝেই মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে, কাজে যোগদান করেও আগের মতো স্বাভাবিকভাবে কাজ কর্ম চালিয়ে যেতে পারছেন না।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে উপরের বিষয়গুলো সম্পর্কে বিশেষ সজাগ থেকে নীচের টিপসগুলো কাজে লাগিয়ে পুলিশ সদস্যরা পুনরায় মানসিকভাবে শক্ত মনোবল ও মানসিক স্বাস্থ্য ফিরে পাবে বলে আশা করি ।

১। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন- ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব থেকে আপাতত দূরে থাকতে হবে।

২। পরিবারপরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী সবার সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এবং নিয়মিত যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।  এব্যপারে সকলের পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন ও সহকর্মী সহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

৩। ভবিষ্যতে বা সামনে ভালো কিছু হবে এই আশা পোষণ করতে হবে। অতীতে নিজের সাথে অনেকেই খারাপ আচরণ করে থাকতে পারে, এমনটি হলে তাকে মন থেকে ঐ সমস্ত ব্যক্তিকে মাফ করে দিতে হবে। অথবা নিজেই নিজের প্রতি কোন অন্যায় করে থাকলে মন থেকে নিজেকে মাফ করে দিতে হবে।

৪। নিজের একান্ত পছন্দের কাজ ( যেমন- গান শোনা, বাগান করা, খেলা করা, লেখা লেখি করা,  প্রভৃতি) করার জন্য সময় বের করে সময় দিতে হবে।

৫। অতীত ও ভবিষ্যতের নেতিবাচক চিন্তা  ভুলে, চিন্তায় বর্তমানে থেকে নিজের কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে হবে।

৬। আমার জীবনের মানে কি? অথবা আমার জীবনের অর্থ কি? নিজেকে এমন প্রশ্ন করে তার উত্তর খোঁজে পাওয়ার মাধ্যমে নিজেকে ভালো রাখতে পারেন। সাধারণত যাদের কাছে এই উত্তর পরিষ্কার, গবেষণায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্য অনেক ভালো পাওয়া গেছে।

৭। জীবনের যে সমস্ত ভালো ছোট, বড় অর্জনগুলো রয়েছে সেগুলো স্মরণ করতে হবে।

৮। অপরের উপকার করতে হবে গবেষণায় দেখা গেছে কেউ কাউকে উপকার করলে উভয় ব্যক্তিরই মস্তিষ্কে একটি প্রশান্তিদায়ক হরমণ নিঃসৃত হয়। ফলে, যাকে উপকার করা হয়, আর যে উপকৃত হয় দুজনেই সমান মানসিক শান্তি লাভ করে।  

৯। সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। হতে পারে তা সৃষ্টি কর্তার প্রতি বা জীবনে যে কারো কাছ থেকে কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে থাকলে তার প্রতি। এতে মানসিক প্রশান্তি লাভ করার পাশাপাশি দ্রুত স্বাভাবিক কাজে ফেরা সম্ভব হবে।  

লেখক- ডঃ মোঃ শাহিনুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Search