জীবনে উৎকণ্ঠা শিকার হননি এমন লোক খুঁজে পাওয়াই কঠিন। আধুনিক জীবনের জটিল চাহিদাগুলো মিটাতে গিয়ে, কর্মক্ষেত্রের চাপ মোকাবিলা করতে গিয়ে বা অন্যান্য সমস্যায় পড়ে মানুষ উৎকণ্ঠাগ্রস্থ হন। আবার অনেক সময় ‘আংজাইটি ডিজঅর্ডার’ নামক মানসিক রোগগ্রস্থ হয়ে অনেকে তীব্র মাত্রায় উৎকণ্ঠার সম্মুখীন হন। উৎকণ্ঠার লক্ষণ হচ্ছে অস্থিরতা, স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া, মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়া, ঘুম কমে যাওয়া, প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখা, গলা শুকিয়ে আসা, শ্বাসের সমস্যা, মাথা ব্যাথা, শরীরের নানা জায়গায় ব্যথা, বুক ধর-ফর করা, হাত-পা কাঁপা, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, নানা রকম দুশ্চিন্তা ইত্যাদি। উৎকণ্ঠা কমাতে রিলাক্সেশন ব্যয়াম খুবই কার্যকর।
উৎকণ্ঠা অল্প হলে তেমন অসুবিধা নেই। কিন্ত যদি সহ্যের বাইরে চলে যায় তাহলে অসুবিধা হয়ে যায়। কিভাবে উৎকণ্ঠার নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে, উৎকণ্ঠা হলে মানুষের মাংসপেশী শক্ত হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় উৎকণ্ঠায় ভুগলে পেশীও দীর্ঘ সময় ধরে শক্ত হয়ে থাকে। পেশী শক্ত হয়ে থাকার ব্যপারটা অনেকে পরিষ্কার বুঝতে পারেন। আবার অনেক সময় এটা এতো সূক্ষ্মভাবে হয় যে, অনেকে বুঝতে পারেননা। কিন্তু তারা কষ্ট ঠিকই পান। দেখা গেছে যে, রিলাক্সশন নামক কয়েক ধরনের ব্যয়ামের সাহায্যে উৎকণ্ঠা কমানো যায়। যেহেতু উৎকণ্ঠায় মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে যায়, তাই রিল্যাক্সেশন ব্যয়ামের সাহায্যে মাংসপেশী শিথিল করা হয়। এজন্য এই ব্যয়ামগুলোকে শিথিলায়ন ব্যয়ামও বলা যায়। অনেকে এই ধরণের ব্যায়ামকে ‘আরামের ব্যায়াম’ বলে থাকেন। দেখা গেছে যে, মাংসপেশী ঠিকমতো শিথিল করতে পারলে উৎকণ্ঠার লক্ষণ কমে যায়।
অনেক ধরনের রিল্যাক্সেশন ব্যয়াম প্রচলিত রয়েছে। নীচে এমনই এক ধরনের রিল্যাক্সেশনের (Progressive Muscle Relaxation) ধাপগুলো উল্লেখ করা হলো।
এই ধরণের রিল্যাক্সেশনে প্রথমে মাংপেশী শক্ত করতে বলা হয়। মাংপেশী শক্ত করার সময়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে। এরপর শিথিল করতে বলা হয়। ব্যায়ামের প্রতিটি ধাপেই প্রথমে মনে মনে ‘মাংসপেশী শক্ত করছি’ এটা বলে শরীরের একটি অংশের মাংসপেশী শক্ত করতে হয়। এরপর মনে মনে ধীরে ধীরে এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুণে মনে মনে ‘আরাম’ বলে চোখ বন্ধ করে সমস্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে আরাম করতে হয়। যতটুকু সময় পেশী শক্ত করা হয়েছিল তার আনুমানিক দুই থেকে তিন গুণ সময় আরাম করতে হয়। তবে আরাম করার সময় গোণার দরকার নেই। অনুমানে করলেই হবে। এসময়ে আরাম করে ধীরে ধীরে শ্বাস নিয়ে পেটে ধরে রেখে আরাম করে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিতে হবে। এরপর ব্যয়াম পরবর্তী ধাপে চলে যেতে হবে। ব্যায়ামটিতে বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে এবং প্রতিটি ধাপেই এই নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।
ব্যায়ামটি করার সময় আরামদায়ক পোশাক পড়তে হবে। খুব আঁটসাঁট পোশাক পরা উচিৎ নয়। খুব ভরা পেটে বা অতিরিক্ত ক্ষুধার্ত অবস্থাতেও ব্যায়ামটি করা ঠিক হবেনা। হাতে আঁটসাঁট ঘড়ি থাকলে বা কোমড়ে বেল্ট বা ফিতা থাকলে আলগা করে নিতে হবে। চোখে চশমা থাকলে বা পায়ে জুতা পড়া থাকলে খুলে নিতে হবে। একটা আরামদায়ক ঘরে মোটামুটি শান্ত পরিবেশে আরামদায়ক একটা চেয়ারে বসে ব্যায়ামটা করা যেতে পারে। ব্যায়ামটিতে পেশী শক্ত করার সময় অতিরিক্ত শক্ত করার চেষ্টা করা যাবেনা। ব্যায়ামটির ধাপ একটু আগে পড়ে হয়ে গেলেও অসুবিধা নেই। ব্যায়ামের দুই-একটি ধাপ বাদ পড়ে গেলেও খুব অসুবিধা নেই। ব্যায়ামটি অতিরিক্ত নিখুঁত করার চেষ্টা করার দরকার নেই। কারো যদি শরীরে কোন ক্ষতস্থান থাকে, অথবা তিনি যদি গর্ভবতী হন অথবা তার যদি অন্য কোন শারীরিক অসুবিধা থাকে তবে ঐ নির্দিষ্ট অঙ্গের ব্যায়ামের ধাপটি বাদ দিয়ে অন্য ধাপগুলো করতে পারেন। প্রয়োজনে তিনি তার ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারেন। রিলাক্সেশন ব্যায়ামটি করার সময় কোন তাড়াহুড়া করার দরকার নেই। ব্যায়ামের সবগুলো ধাপ করা হয়ে গেলে বালিশ ছাড়া মোটামুটি শক্ত একটি বিছানায় চিৎ হয়ে চোখ বন্ধ করে মিনিট দশেক চুপ-চাপ শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় পুরো ব্যায়ামটি বালিশ ছাড়া শক্ত বিছানায় শুয়ে শুয়ে করলে। তবে ধাপ ৬, ৭, ও ১০ শুয়ে করা কঠিন। এগুলো বসে করে, শুয়ে রিলাক্স করতে হবে। পুরো ব্যায়ামটি করতে বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট লাগে। দিনে দুই বার করে এই ব্যায়ামটি অভ্যাস করা যায়। যদি বেশী উৎকণ্ঠা থাকে তবে তার থেকে বেশীও অভ্যাস করা যায়।
রিল্যাক্সেশন ব্যায়ামের কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এছাড়া এর অনেক ধরনের উপকার আছে বিধায় অনেকে এই ধরণের রিলাক্সেশন ব্যয়ামকে ‘বিহেভিয়রাল এসপিরিন’ বা আচরণমূলক এসপিরিন বলে অভিহিত করে থাকেন। লক্ষ্য করবেন, এসপিরিন ঔষধের মতোই রিলাক্সেশনেরও অনেক ধরনের উপকার আছে।
রিলাক্সেশন ব্যায়াম শুরু করার আগে আপনার সমস্ত শরীরে ও মনে বিদ্যমান উৎকণ্ঠা পরিমানের শতকরা হার একটা সাদা কাগজে লিখে নিতে পারেন। এরপর ব্যায়ামটি শেষে এই হার কতো হলো তাও লিখতে পারেন। এভাবে ব্যায়াম করলে রিলাক্সেশন এর মাধ্যমে আপনার উৎকণ্ঠা কমছে কিনা তা নিশ্চিত হতে পারবেন।
নীচে রিলাক্সেশনের ধাপগুলো উল্লেখ করা হলো-
ধাপ-১। ডান এবং বাম হাতের মুঠি শক্ত করে মনে মনে পাঁচ গুণে তারপর শিথিল করে চোখ বন্ধ করে আরাম করা। পেশী শক্ত করা ও শিথীল করা বিষয়ে একটু আগেই বলা হয়েছে। প্রতিটি ধাপ সেভাবেই করতে হবে।
ধাপ-২। ডান এবং বাম হাতের মুঠি শক্ত করে বাঁকিয়ে কাঁধের কাছে আনা এবং ধীরে ধীরে হাত সোজা করে শিথিল করা।
ধাপ-৩। ভ্রু উপরের দিকে তুলে কপাল কুঁচকানো এবং স্বাভাবিক করা।
ধাপ-৪। মুখে বাতাস ভরে গাল ফোলানো ও আরাম করা।
ধাপ-৫। নাকে দুর্গন্ধ লাগলে আমরা যেভাবে নাক-মুখ কুঁচকাই সেভাবে নাক-মুখ কুঁচকিয়ে তারপর আবার স্বাভাবিক করে আরাম করা।
ধাপ-৬। চোয়াল শক্ত করে থুতনির গায়ে ঠেকিয়ে দুই কাঁধ উপরের দিকে ধরা এবং এগুলো স্বাভাবিক করে আরাম করা।
ধাপ-৭। দুই হাত শক্ত করে পিঠের দিকে প্রজাপতির মত বাঁকিয়ে নেয়া, অর্থাৎ পিঠের কাছে হাতের যে হাড় দুটো আছে সেগুলো কাছাকাছি নিয়ে আসা এবং পরে হাত স্বাভাবিক অবস্থায় এনে আরাম করা।
ধাপ-৮। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পেটের পেশিগুলো পিছনের দিকে টেনে শক্ত করা এবং স্বাভাবিক করে আরাম করা।
ধাপ-৯। মাথা পিছনের দিকে যতটা সম্ভব শক্ত করা এবং আরাম করা।
ধাপ-১০। চেয়ারে বসা অবস্থায় নিতম্বের দুই অংশ কাছাকাছি এনে চেয়ারে চাপ দিয়ে বসে মলদ্বারে উপরের দিকে টেনে নিয়ে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় এনে আরাম করা।
ধাপ-১১। বসা অবস্থায় দুই পা টান করে সামনের দিকে দিয়ে পায়ের আঙ্গুলগুলো উপরের দিকে বাঁকিয়ে মনে মনে আবার এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গোনা। এরপর পা স্বাভাবিক অবস্থায় এনে শিথিল করে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আরাম করা।
ধাপ-১২। বালিশ ছাড়া বিছানায় চিৎ হয়ে চোখ বন্ধ করে চুপ করে বিশ মিনিট শুয়ে থাকুন।
ব্যায়ামটি নিয়মিত অভ্যাস করলে এক সময়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যখন পুরো ব্যায়ামটি না করে শুধুমাত্র ‘আরাম’ শব্দটি ব্যায়ামের শিথিলায়ন বা আরামের অনুভূতি তৈরি করা সম্ভব হবে। তবে এর জন্য অনেক অনুশীলন প্রয়োজন। প্রথম দিকে ব্যায়ামটি করতে গিয়ে কঠিন লাগতে পারে। ভালো হয় যিনি ব্যায়ামটি জানেন এমন কারো কাছে হাতে কলমে এটি ভালো ভাবে ভাবে শিখে নিয়ে এরপর নিজে নিজেই এর চর্চা করা।
লেখকঃ মোঃ জহির উদ্দিন, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, সহকারী অধ্যাপক, সাইকথেরাপি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা।