বৃদ্ধাশ্রম (Old home)
দেশে স্বাস্থ্যখাতে ভাল অগ্রগতি হয়েছে। বেড়েছে গড় আয়ু। এখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ঊনসত্তর দশমিক পাঁচ বছর। সময়ের সাথে সাথে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে। ২০০১ সালে পরিচালিত আদম শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬৫ বছরের বেশী বয়সী মানুষের সংখ্যা ৪৭,৬১,৭০০ জন। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে সময়ের সাথে সাথে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা আরো বাড়তে থাকবে। বিশেষজ্ঞদের মতে ২০৫০ সাল নাগাদ ষাটোর্ধ্ব মানুষের পরিমাণ দেশের সমস্ত জনগোষ্ঠীর শতকরা তেইশ ভাগ হবে।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের সমাজ পরিবর্তীত হচ্ছে। জীবন-জীবিকার খুজে মানুষ ছুটেছে দেশ-দেশান্তরে। মানুষ আর জমির উপর নির্ভরশীল নয়। বড় পরিবার কাঠামো ভেঙ্গে পড়ছে। বেশীর ভাগ পরিবারই একক পরিবার-বাবা, মা ও সন্তানদের সমন্বয়ে গঠিত। সন্তান সংখ্যাও কমে এক বা দুটিতে এসে ঠেকেছে। পুরানো সমাজিক প্রথাগুলো ভেঙ্গে পড়ছে। বদলেছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীও।বাস্তবতা এমন হয়েছে যে, অনেক সময়ই বয়োবৃদ্ধদের পরিবারের সদস্যরা যত্ন নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বৃদ্ধরা অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় পড়ছেন। বার্ধক্য জনিত নানা রোগে তাদের অনেকের নিজের যত্ন নিজে নেবার অবস্থাও থাকেনা। আয়-রুজি বন্ধ। সঞ্চিত টাকা থাকেনা অনেকেরই। দেখার কেউ নেই। যারা পরিবারের মধ্যে থাকেন তাদেরও একটি অংশ চরম অবহেলার শিকার হচ্ছেন।
এধরণের পরিস্থিতিতে উন্নত পৃথিবীতে প্রবীণ নিবাস বা বৃদ্ধাশ্রম আছে। আমাদের দেশে এই ধরণের সুযোগ এতো কম যে প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু এখন বৃদ্ধাশ্রমের বাস্তব চাহিদা তৈরী হয়েছে। সমাজের অনেকেই বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। কিন্তু কিভাবে একা পড়ে যাওয়া প্রবীণদের যত্ন নিশ্চিত করা যায় তার ভাল কোন বিকল্প দিতে পারছেননা কেউ। কেউ বলছেন পরিবারকেই, সন্তান-সন্ততিকেই এই দায়ীত্ব নিতে হবে। না নিলে তাদের বাধ্য করতে হবে। কেউ বলছেন মানসম্মত পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রবীণ নিবাস স্থাপনের কথা। যখন পরিবার নেই অন্ততঃ তখন যাতে প্রবীণদের একটা ভাল আশ্রয় মিলে।
আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমের নিতান্তই অভাব আছে। প্রায় নেই বললেই চলে। সরকার বিভিন্নভাবে বৃদ্ধাশ্রম গুলোর কার্যক্রমে সহায়তা দিয়ে থাকেন। প্রবীণ হিতৈষী সংঘ নামের একটি সংগঠন ঢাকার আগারগাওয়ে প্রবীণ নিবাস পরিচালনা করছেন। এছাড়া বেসরকারী উদ্যোগে ঢাকার শ্যামলী, পাবনা ও দিনাজপুরে একটি করে প্রবীণ নিবাস পরিচালিত হচ্ছে।
এছাড়া গিভেন্সি গ্রুপ অব ইন্ডাষ্ট্রিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচলক খতিব আব্দুল জহিদ মুকুলের উদ্যোগে গাজিপুরে একটি, রাঙামাটিতে একটি এবং সাভারে দুটি বৃদ্ধাশ্রম পরিচালিত হয়। এই প্রবীণ নিবাসের সম্পূর্ণ খরচ কর্তৃপক্ষ বহন করেন। ষাট বছর বয়স বা তার বেশী বয়সীরা প্রবীণ নিবাসে থাকতে পারেন। প্রবীণ নিবাসে ভর্তির শর্ত হচ্ছে তাদের মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে এবং বড় ধরণের কোন শারীরিক পঙ্গুত্ব মুক্ত থাকতে হবে। বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা মাসিক হারে দিয়ে থাকতে হয়। প্রবীণ নিবাসে প্রবীণদের নিজের কাজ করতে হয়। যেমন, গোসল ইত্যাদি করা, নিজের কাপড় ধোয়া ইত্যাদি তাদের নিজেদের করতে হয়। প্রবীণ নিবাসে সুযোগ সুবিধার দিক থেকে বেশ তারমতম্য পরিলক্ষিত হয়। ভাল নিবাসগুলোতে চিত্তবিনোদন, চিকিৎসা সেবাসহ বিভিন্ন ধরণের সেবা পাওয়া যায়।
প্রবীণদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আর কিছু উদ্যোগ তাদের পরিকল্পনায় আছে। প্রবীণদের জন্য সরকার জনপ্রতি মাসিক তিনশত টাকা করে একটি সীমিত আকারের বৃত্তি চালু করেছেন। ২০১১-১২ অর্থবছরে এই খাতে ৮৯১ কোটি টাকা বরাদ্ধ করা হয়েছে। প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসাবে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভায় প্রবীণদের জন্য ‘ন্যাশনাল পলিসি অন এলডার্লি পিপল’ শীর্ষক একটি নীতিমালার খসড়া পাশ করা হয়েছে। এই নীতিমালাটি প্রক্রিয়াধীণ আছে। এই নীতিমালা অনুযায়ী ৬০ বা তদোর্ধ্ব মানুষেরা প্রবীণ নাগরিক বলে স্বীকৃত হবেন। প্রবীণদের পরিচয়পত্র ও স্বাস্থ্যকার্ড দেয়া হবে।
বিভিন্ন গণপরিবহনে তাদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকবে এবং তারা স্বল্পমূল্যে টিকেট কেটে পরিবহন ব্যবহার করতে পারবেন। নীতিমালা অনুযায়ী সরকার বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করবেন ও প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবেন। তাদের জন্য সঞ্চয় প্রকল্পও চালু করা হবে। এছাড়া সরকার প্রবীণদের কল্যাণে পরিচালিত বেসরকারী উদ্যোগকেও উৎসাহিত করবেন। গত ২৪শে অক্টেবার ২০১৩ সালে পার্লামেন্টে ‘প্যারেন্টস কেয়ার অ্যাক্ট’ নামের একটি আইন পাশ হয়েছে যে আইনে সন্তান যদি পিতামাতার ভরণ-পোষণ করতে ব্যর্থ হন তবে তাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সন্তানকে তিন মাসের জেল বা এক লক্ষ টাকা জড়িমানা করা যেতে পারে। আইন করে প্রবীণদের সমস্যার পুরো সমাধান করা না গেলেও এর মাধ্যমে সরকারী ভাবে প্রবীণদের যত্ন নেবার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হলো।
প্রবীণেরা পরিবারের সাথেই থাকুন, আর প্রবীণ নিবাসেই থাকুন, তাদের নিজেদেরকে ভাল রাখার জন্য তাদের সচেতন হতে হবে।
পরিবারের সদস্যরা বা প্রবীণ নিবাসের যত্ন গ্রহণকারীরা প্রবীণদেরকে ভাল থাকার উপায়গুলো মেনে চলার জন্য উৎসাহিত করতে পারেন। ভাল থাকার কতগুলো উপায় নিচে দেয়া হলো।
- স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা ও স্বাস্থ্য সম্মত জীবন-যাপন করা.
- দ্রুত শারীরিক ও মানসিক রোগ সনাক্ত করে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা,
- হাটা, শরীরচর্চা, ওজন কমানো, লেখাপড়ার মাধ্যমে মস্তিকের ক্রিয়া চালু রাখা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, স্বেচ্ছাশ্রম, ধূমপান ত্যাগ, মদ্যপান ত্যাগ, মাদক গ্রহণ বর্জন ইত্যাদিতে উৎসাহিত করা।
- প্রবীণদের রক্তে কোলেস্টরল কম রাখা, রক্তে চিনির পরিমাণ কম রাখা, রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা গ্রহণে ও স্বাস্থ্যকর জীবন প্রণালী অনুসরণ করতে উৎসাহিত করা।
- তাদের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মাত্রামতো ঔষধ খেতে ও নিয়মিত ডাক্তারর তত্বাবধানে চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করা।
- তাদের কৌতুক, গান, আড্ডা, বেড়ানো, শখের কাজে ব্যস্ত থাকতে এবং মন সতেজ রাখতে উৎসাহিত করা।
- জীবনের চাপ কমাতে উৎসাহিত করা।
- ধর্মীয় জীবন-যাপনে উৎসাহিত করা।
- সমাজিকতা বজায় রাখতে উৎসাহিত করা।
- প্রবীণদেও দায়ীত্ব হচ্ছে নেতিবাচক চিন্তাকে প্রশ্রয় না দেয়া। এগুলো মুখ দিয়ে উচ্চারণও করা চলবেনা। আশাবাদী হতে হবে। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। সৃষ্টিকর্তা চাইলে বিপদ থেকে ত্রাণ করতে পারেন এমনটা ভাবা। হতাশা প্রশ্রয় না
- দেয়া।
- নিজেকে বুড়ো ভাবা চলবেনা। বুড়ো ভাবলেই বুড়ো। না ভাবলে মন সতেজ থাকেবে। শরীরও থাকবে ভাল।
- জীবনের নতুন অর্থ দাঁড় করানো। পরিবার ও সমাজে বয়স উপযোগী একটি ভূমিকা খুজে নেয়া ও তা পালন করা। নাতিপুতি নিয়ে থাকা যেতে পারে। তাদের সাথে খেলুন। গল্প করুন। তাদের স্কুল থেকে আনা নেয়ায় সাহায্য করুন।
- সংসারের টুকি-টাকি কাজ করা যেতে পারে। রান্না-বান্না করা, বাজার করা, বিল দেয়া ইত্যাদি করুন।
- পর্যাপ্ত ঘুম দেয়া। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমানো চলবেনা।
- সখের কাজ করা। বাগান করা, গাছ লাগানো, বেড়ানো ইত্যাদি কাজ করা যেতে পারে।
- মাত্রামতো পরিশ্রম করা। অধিক বিশ্রামে শরীর ভেঙ্গে যাবে।
- জীবনের সুস্থ রুটিন বজায় রাখা দরকার। নিয়মিত সকালে ঘুম থেকে উঠুন ও সময়মতো ঘুমাতে যান। নিয়মিত গোসল করুন, দাঁত মাজুন ও নখ কাটুন।
প্রবীণদের জন্য মানসম্মত বৃদ্ধাশ্রম করা প্রয়োজন। এই বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে যাতে একধরণের সামাজিক পরিবেশ থাকে এবং এখানে প্রবীণেরা যাতে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, নিরাপত্তা, চিকিৎসা, ধর্মীয় পরিবেশ সহ সার্বিক সহায়তা পান তা নিশ্চিত করতে হবে। যে সব প্রবীণদের পরিবার তাদের দায়ীত্ব নিতে পারছেননা তারা এই প্রবীণ নিবাসগুলোতে থাকবেন। এছাড়া পরিবারের সদস্যরা তাদেরকে মাঝে মাঝে দেখতে আসবেন ও তারাও তাদের বাড়িতে বেড়িয়ে আসবেন।
বাংলাদেশ সরকার প্রবীণদের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে করার আছে অনেক কিছু। সরকারী উদ্যোগে আরো প্রবীণ নিবাস স্থাপন করা দরকার। তাদের চিকিৎসা সেবার জন্যও অনেক সুযোগ-সুবিধা তৈরী করা দরকার। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রবীণদের সংখ্যা যেই হারে বাড়ছে সেই হারে প্রবীণদের সমর্থন দেয়ার মতো, তাদের আবাসন ও চিকিৎসার সুবিধগুলো গড়ে উঠেনি। শুধু সরকরি উদ্যোগে এতো বিপুল সমস্যার সমাধান হবেনা। এজন্য সচেতন সবারই এগিয়ে আসা উচিত।
লেখকঃ মোঃ জহির উদ্দিন, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিষ্ট, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।
One Response
ধন্যবাদ স্যার, আপনার সুনির্দ্দিষ্ট পরামর্শের জন্য।